অপ্রয়োজনীয় কথা
(প্রথম খসড়া, ভুলের গুলিতে জর্জরিত, তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী)
মেয়েটা যখন তাকায় তখন চোখ গুলো বড় বড় হয় । যখন কথা বলে তখন স্বরে একটা আত্মবিশ্বাস থাকে। বিরক্ত হলে সেই স্বর রুঢ় হয়ে যায় চোখের পলকে । তবে শুনতে খারাপ লাগে না । লজিকে গন্ডগোল মনে হলে সাথে সাথে জবাব দিয়ে দেয়। তার হাসির শব্দটা খুবই বিরল । হাতে গোনা কানই সেই সৌভাগ্যের অধিকারি হয়। আমি ভাগ্যবান মানুষ না হলেও সেই হাসি শোনার সুযোগ আমার হয়েছে । হয়েছে বলেই সেই হাসি আমার কানে বাজে । নানান আয়োজনে তৈরী হাল আমলের ইংরেজি-হিন্দি গান তাই কানে বেসুরো লাগে। যদি তার হাসিটা রেকর্ড করে রাখা যেতো! বার বার শুনতে ইচ্ছে করে । কিন্তু সেই সুযোগ কি হবে? মনে হয় না ।
আমি মানুষ্টা রসকষহীন একটা জীব । নানান তাগাদার ভীড়ের ঠেলায় কিভাবে যে দুই যুগে পা দিয়েছি সেটা ভাবলে অবাক হই! কয়েক বছর আগেও এই সময়টা এত কিম্ভূত লাগতো যে ভেবেছিলাম এইখানেই "দাড়ি" বসিয়ে দিই । যতবার মন অশান্ত হয়েছে, ততবার নিজেকে এই বলে শান্তনা দিয়েছি । কথার মাঝেই আমার শান্তনা আটকে রইলো । জীবনে আর "দাড়ি" বসাতে পারলাম না । যা আমি পারি নি আমার বন্ধু মাজহার সেটা করে দেখালো । সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে বেশ খোশগল্প করলো । বুটমুড়ি খেলো । পরে বন্ধুরা শহর ঘুড়তে বের হলো । আর মাজহার সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে দিলো । কত সহজ একটা কাজ। আমি করতে পারলাম না । আপসস হয় ।
এই আপসসের মধ্যে দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় নামক চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করলাম । সিনিয়র ভাই, সালাম, রেগিং, কারিকুলাম নামক শব্দ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তখন । সেই শব্দের মাঝে নিরবে একটা স্বপ্ন এলো। না, দুঃস্বপ্ন ।
সেই দুঃস্বপ্ন দেখেছি আবছা শরীরের এক মেয়েকে । ছোট্ট একটা ঘরের ভেতর একটা খাটের উপর শুয়ে আছে সে । না পড়ে আছে । রোগাক্রান্ত । প্রায় স্পষ্ট চেহারায় জেল্লা নেই । সৌন্দর্যের শেষ ফোঁটা তার চোখের বিন্দু তে । সেটাও যখন তখন বন্ধ হবে । আমি দাঁড়িয়ে আছি তার মাথার পাশে ।
আমার শরীর অবশ । কি করবো না করবো সে ব্যাপারে একদমই হুশ নেই । কান্না পাচ্ছে কিন্তু কাদছি না । হঠাৎ ঘর থেকে বের হলাম । হসপিটাল বা ক্লিনিক এ যেতে হবে । রিক্সা বা সিএনজি খুজতে হবে । বের হয়েই বুঝলাম রাত অনেক হয়েছে । আমার হাতে ঘড়ি নেই । মোবাইল নামক জিনিসটাও কোনো কারণে স্বপ্নে নিরুদ্দেশ । ঝি ঝি পোকার শব্দ নেই । কুকুরের ডাক নেই । শুধু আকাশ থেকে কালো মেঘের হুংকার এর শব্দ কানে আসছে আর চোখে পড়ছে রাগি রাগি বিদ্যুৎচমক। রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছি । কোনো যানবাহনের দেখাই যে আমি পাবোনা এ নিশ্চিত । আমি হাল ছেড়ে দিলাম । মনটা কেমন হালকা হয়ে এলো । মাথা থেকে ভয় নামক পাথরটা গাল বেয়ে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়লো । আমি আকাশের দিকে তাকালাম । তখনই বৃষ্টি নামলো । আমি চোখ বুজলাম । বৃষ্টির পানি আমার বিষাদের কান্না ধুয়ে দিচ্ছে । আমার কানে ভারি যানের শব্দ এলো । শব্দটা এগিয়ে আসছে তীব্র গতিতে । হেডলাইটের আলো আমার মুখের উপর পড়লো । ভীষণ ধাক্কা । তারপর অন্ধকার । অন্ধকার । অন্ধকার ।
এই একটা স্বপ্ন নানান ভাবে মাসের পর মাস ধরে আমার মাথায় থিয়েটারের মতে চলেছে । বিষয়বস্তু একই । মেয়ে মৃত্যুশয্যায় । আমি হতাশায় । গভীর রাত । বাহিরে ঝড় । তারপর ট্রাকের ধাক্কায় আমার মৃত্যু। “কেনো এই স্বপ্ন দেখছি” প্রশ্নটা আমি নিজেকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি তার হিসেব নেই । ভর্তির সময় আমার নিজভুলে আমার ডিপার্টমেন্ট এলো আর্কিওলোজি । সেখানে ভর্তি হলাম । একটা ইন্ট্রো সেশনে যোগ দিয়েছিলাম । প্রথম সপ্তাহে সিনিয়র আমাদের গোল করে নিয়ে গেলো সামাজিক বনায়নে । আমরা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম । পরিচয়পর্ব ব্যাপারটায় যে এতো প্যাচ হবে ভাবিনি!
যাইহোক একটা মাস কোনোরকমে ক্লাস করে একদিন শুনলাম ডিপার্ডমেন্ট চেঞ্জ হবে । চয়েস এ প্রথমেই ল দিয়েছিলাম । তারপরেই ইংরেজি । ল আসার মতো আমার নাম্বার আর সিট দুইটার কোনোটাই ছিলো না । তবু ইংরেজি এলো । গড়িমসি করে প্রথমদিন ক্লাস করলাম । ব্যাচমেটদের কারোর চেহারা সেদিন পরখ করি নি । সেই না করা মুড থেকেছে সপ্তাহখানেক । বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছি । ক্লাস করছি । বাসায় যাচ্ছি । এই চক্রেই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম । এর মধ্যে ক্লাসের পড়া বোঝা, গল্প-প্রবন্ধ-কবিতার জট খুলতে হিমশিম খাচ্ছিলাম । প্রথম মিডটা যখন শেষ হলো তখন কিছুটা হাফ কিছুটা ছেড়েছি । এতোদিন চারপাশের সারাশব্দ কানে আসতে দেই নি । এইবার একটূ একটূ করে আওয়াজ পেতে লাগলাম । সেই আওয়াজের মাঝে একটা সুক্ষ্ম আওয়াজ আমার মাথায় পিনের মতো ঢুকলো । শব্দটা অনুসরণ করতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম । সেই ধাক্কার রেশ চললো বহুদিন । রেশ কাটতে কাটতে বছর কেটে গেলো । তারপর এপ্রিলে "সে" এলো । নিরবতা ভেঙে সরব হলাম । নিরবতা আড়ালে ছিলো এই সব শব্দের মাঝে । রেশ যে কেটেছে এমনও না । কাটার কথাও না । রঙিন সিনেমার মতো সাদামাটা এই জীবনে কয়টা মানুষ স্বপ্নে “সে” কে পায় ? তারপর তাঁর থাকা না থাকা সেটা পরের বিষয় । এসেছে এটাই পরম বিশ্ময় । সেই বিশ্ময় কি এতো সহজে কাটবে?
Comments