নতুন মানব

 

একদা এক মানুষ ছিলো । অপূর্ণ । নিকৃষ্ট । 

পৃথিবীতে আসলে পরিচয় একটা মেলে । তারও আছে । তবে আমরা তাকে সে পরিচয়ে জানবোনা। তাঁর অধিকার নেই । তাকে আমরা ডাকবো একটা মানুষ বলে ।

এখন এই মানুষটা জীবনের অর্ধেক কাটিয়ে দিয়েছে কোনো অর্জন ছাড়া । 

জীবন নামের এই দৌড় প্রতিযোগিতায় সেও যে একজন প্রতিযোগী তা তাঁর বুঝতে সময় লেগেছে বহুবছর । এই অবুঝ সময়টায় তাঁর কেটেছে খেলায় । ভালোবাসা নামক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবাণু কারোর জন্যে আশির্বাদ নিয়ে আনে । তেমনটা আমাদের এই মানুষটার সাথে হয় নি । হওয়ার কথা না । নিকৃষ্ট মানুষকে তাঁর প্রতিবেশী মানুষ যেমন পছন্দ করে না তেমনি জীবনও করে না । তাই ভালোবাসা তাঁর ক্ষুদ্র জীবনে হয়ে এলো ব্যাধি হয়ে । এক প্রাণঘাতি ব্যাধি । মানুষটা শুরুতে বুঝতে না পারলেও আঁচ করতে পেরেছিল । তবু নিজের মনে আসতে দিলো অদ্ভুত, অজানা আর পরম তৃপ্তির এই অনুভূতিকে । দিন গড়িয়ে সপ্তাহ এলো । অনুভূতি তাকে জানিয়ে দিলো কিছু একটা ঠিক নেই । কিন্তু কি সেটা সে নির্দিষ্ট করে বলতে পারলো না । এই অনিশ্চয়তায় আরও খানিক সপ্তাহ কাটলো । আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তা দূর করেছে । ভেতরের আরেক আমি বারবার তাঁর কানে ফিসফিস করছে সেই কিছু একটা তুই নিজেই । তুই ঠিক নেই । কিন্তু কেনো নেই সেটার উত্তর আর পেলো না ।  

পাওয়ার কথা না । জীবন এভাবে কাজ করে না । তাঁর কাজ প্রশ্নের যোগান দেয়া। উত্তর খোজার মতো পাহাড় ভাঙ্গার কাজ মানুষের । তাই আমাদের মানুষটা পাহাড় ভাঙতে লেগে পড়লো । হাতে শাবল নেই, আছে কলম । শক্ত পাথর এর বদলে আছে মোলায়েম সাদা কাগজ । তবে শ্রম এ তফাত নেই । সে চিন্তার বিশাল পাহাড়ে বার বার আঘাত করছে । সেই আঘাতে টুকরা টুকরা শব্দ বের হয়ে আসছে । একটা একটা করে শব্দ নিয়ে একটা বাক্য বানাচ্ছে । দিনের আলো হেলে পড়ে এক পাশে । পেটে ক্ষিদের টান পড়লে বিরতি দেয় । চোখ বুলিয়ে দেখে, যে শ্রম দিয়েছে তাতে অর্জন অতি সামান্য । 

তবে এই পাহাড় ভেঙ্গে মানুষটা যে উত্তর পাবে না সেটা কেউ তাকে বলে নি । কেউ বলে নি এই পাহাড় কাটার পর যে পথ বের হবে সেটা তাকে নিয়ে যাবে মরিচীকার অরণ্যে । তবে পাহাড় তাঁর আর কাটা হয় নি । তাই পথ সম্পর্কেও সে আর জানতে পারেনি । 

তবে মানুষ জানতে পারে । দেরিতে হলেও । আমাদের মানুষটাও জানতে পারলো । পৃথিবীতে আগমনের দুই যুগ পরে । মানুষটার সেই জানা হলো ও বড় অদ্ভত ভাবে। স্বপ্ন নামক রহস্যময় এক ব্যাপারের মধ্যে দিয়ে। জীবন বড় খামখেয়ালি । কখন যে সে কাকে এই বর দেয় সেটা বোঝা মুশকিল । শত বছরের সন্যাসি সাধনা করেও এই বর পায় না, অথচ তুচ্ছাতিতুচ্ছ এক কীট সেই বর পেল! ভাবনার বিষয় । মানুষটা ভেবেছেও অনেক । আর ভেবে যে উত্তরটা গড়ে নিলো, সেটা এইঃ তাঁর জীবন যেহেতু প্রায় সবটাই সাদামাটাভাবে কেটেছে সেহেতু জীবন করুণা করে তাঁর এই রংহীন জীবনে একটুকু বর্ণচ্ছটা দিতে স্বপ্ন নামক এই বর দিয়েছে । 

আর কি পেয়েছে সে এই বর থেকে? দুটো জিনিস । এক, মানবীর সঙ্গ । দুই, মৃত্যু । এখানে মৃত্যু আছে দেখেই মানুষটা বরকে অভিশাপ বলতে ইচ্ছে করে । কিন্তু বলেনা । জীবন যদি তাকে অকৃতজ্ঞ মনে করে? তাই সে ভাবে । মানবীকে নিয়ে । ভাবলে কিছুক্ষণ এর জন্যে সে ভুলে যায় সে তুচ্ছ । ভুলে যায় এই গ্রহে অতি সাময়িক সময়ের জন্যে সে এসেছে । ভুলে যায় ক্লান্তিকর অতীত । ভবিষৎ নামেও যে একটা কাল আছে সেটা সে মানবীকে ভাবতে গিয়ে আবিষ্কার করে । সে ভাবে ভাবে ভাবে । সময় এসে কড়া নাড়ে । সে জবাব দেয় না । সে এবার সাহস করে মানবীর সাথে কথা বলে । মানবী সাড়া দেয় । তাঁর ভালো লাগে । সে মানবীকে ডাকে । মানবী সাড়া দেয় । তাঁর বেশ ভালো লাগে । মানুষটা এক পর্যায়ে আর শুধু মানুষ থাকে না । তাঁর একটা বিশেষ আলাদা সত্তা জাগে । সেই সত্তার পরিবর্তন দেখে তাঁর চারপাশের আরও সত্তারা । তাঁরা কানে কানে এসে বলে মানবীর কথা । যেই কথার রঙ্ একই সাথে সাদা আবার একই সাথে কালো । সেটা কি করে সম্ভব? মানুষটার মাঝে প্রশ্ন জাগে । সে উত্তর খোজে মানবীর কাছে । মানবী যে উত্তর দেয় তাতে তাঁর সন্তুষ্ট হতে ইচ্ছে করে । তবু, কিন্তু, পরন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনে জাগছে । সে মস্তিষ্কের বন্ধ কামরার মেঝেতে এই সবের কবর দেয় । তবে রাতে সেগুলো ভূত, পিশাচ হয়ে তার ওপর ভর করে । 

তাঁর সাথে ভর করলো আরেকটা পিশাচ । যে পিশাচ যাকে ভর করে তাঁর মনের মানুষ কে "কাছে পাওয়ার" ইচ্ছা বেড়ে যায় । আমাদের মানুষটারও বাড়লো । কালা জ্বরের মতো হু হু করে । সেই পেতে চাওয়ার ঘোরে ভুলেই গেলো যে মানুষটা তুচ্ছ । কালা জ্বরে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে । মানুষটার জন্যেও সেই সম্ভাবনার দরজা খুললো । সেই মৃত্যু এলো আরেকটা মানুষের চেহারার বেশে । এ হলো মানবীর মানব । একটা পূর্ণ মানুষ । যাকে তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না ।


২৯ এবং ৩০/০৭/২৪ । রাত ২ঃ৩৭ ।


Comments

Popular posts from this blog

অনর্থক

Why Not to Fall in Love with your Dream Girl

হ্যাপিম্যান