হ্যাপিম্যান

 














“Let me forget what life is and learn again”





ফখরুদ্দিন মুহাম্মদ আশ শামস ওয়ালিউল্লাহ একজন সুখি মানুষ । তার রাত নামের মতোই দীর্ঘ । আলোর দূষণ না থাকলে হয়তো সে রাতটা তারা গুণে কাটাতো। বাধ্য হয়ে তাই এখন মশারির ভেতর মশা গুনছে। ৫টা গোনার পর মনে প্রশ্ন জাগলো । মশা কি পাঁচটা নাকি একই মশা পাঁচ বার করে কানের কাছে তাওয়াফ করছে? চিন্তার বিষয় । সুখি মানুষের সফরসঙ্গি। সঙ্গিহীন ফখরুদ্দিন ঠোট কামড়ালো। চোখগুলো কুচকে এলো। কেঁদে ফেলবে কেঁদে ফেলবে ভাব। কিন্তু কাঁদে না। এসব ফখরুদ্দিনের চিন্তার ফসল। একটা মশা পি পি করে এসে তার কানের কাছে এলো। আরও কিছুক্ষণ পি পি করে কানের লতির পিছনে গিয়ে বসলো। ফখরুদ্দিন হাতটা অতি কৌশলে নিরব ঘাতকের মতো করে শা করে লতি বরাবর টার্গেট করলো । ডান কানটায় রিংং– করে উঠলো। ধ্যাত! টার্গেটটা মিস হয়ে গেল । বেহাত হওয়া মশা পি পি করে চলে গেলো। ফখরুদ্দিন ব্যাথায় এখন কান ঘষছে ।


মোতজার্টের লেক্রিমোসা বেজে উঠলো। কেউ কল করেছে । মোতজার্টের ধ্বনি যেহেতু জ্যামিতিক হারে বাড়ে তাই কলটা কানে যেতে সময় লাগলো। কলার আইডি ছিলো না, তাই কল ধরে জিজ্ঞেস করতে হলো,

  • আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?

  • এটা কি ফখরুদ্দিন ভাই এর নাম্বার?

  • জ্বি, আপনি কে বলছেন?

  • ভাই আমার নাম জহির। আপনার নাম্বারটা আমি ইব্রাহিম ভাই থেকে পেয়েছি

  • ও আচ্ছা

  • ভাই আমার ওয়াইফের এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। ইব্রাহিম ভাই হয়তো আগে বলেছেন?

  • জ্বি বলেছিল

  • যদি আসতেন মেডিকেলে। রক্তটা এখনি দরকার ।


ফখরুদ্দিনের চোখ দেয়াল ঘড়ির দিকে গেলো । রাত একটা বাজতে আর্ ১৫ মিনিট বাকি । মিনিটের কাটা এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে সে সময়টাও পার করে ফেলবে। 


  • ইয়ে মানে…

  •  ভাই কি এই মাসে রক্ত দিয়ে ফেলেছেন?

  • না না দেই নি । আসবো । আসছি । ভাববেন না। এসে আপনাকে এই নাম্বারেই কল দিবো 

  • জ্বি জ্বি, ধন্যবাদ ভাই, অসংখ্য ধন্যবাদ!

  • ঠিক আছে । আসসালামু আলাইকুম


কলটা কাটতেই ফখরুদ্দিনের মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো । কেউ যেন অতি সুক্ষ্ম একটা সুই মাথার মাঝ বরাবর ঢুকিয়ে দিয়েছে । যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে ই ওয়াশরুমে ঢুকলো । ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চেয়ার এ রাখা লাল গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ভাবলো, না গেলে কি হয়? পথে যদি ছিনতাইকারি ধরে সব রেখে দেয়? অথবা শুধু যদি চাকু বুকের মাঝে সেধিয়ে দেয়? দিলে অবশ্য খারাপ হয় না । দুনিয়া থেকে মুক্তির টিকেট পেয়ে যাবে । এর জন্যে না হয় আগে বেদনা এক্সপ্রেস এ অনিচ্ছাস্বত্তেও চড়তে হবে। 


সমস্যা হলো কথা দিয়ে ফেলেছি । কথা দেয়া আত্মা বন্ধক দেয়ার সমান । কথা রেখেই সেটা ফেরত পাওয়া সম্ভব। ফখরুদ্দিনের চোখটা আবার ঘড়ির দিকে ফিরলো । রাত একটা বাজে । ট্রাউজার খুলে প্যান্ট  পড়ার পর ভাবলো আন্ডারওয়ের পড়া হয়নি । পড়লে ভালো হয়? না থাক । প্যান্ট পড়ার আগে ভাবা উচিত ছিল । অথবা ট্রাউজারটাই পড়া থাকতো । এখন আবার প্যান্ট খোলার ইচ্ছে ফখরুদ্দিনের হচ্ছে না । এক এক করে মোবাইল, মানিব্যাগ আর গেইটের চাবি পকেটস্ত করলো । আর কিছু নেয়া বাকি আছে? “রক্ত নিয়েছিস মনে করে?” দুই বাহু টিপে ভাবলো, মনে তো হয় । নিজের জোকে নিজেই হাসলো। নাহ, তামাশা করার সময় এখন না । এখনি বের হতে হবে । দেরি হলে আবার রোগীর কি হয় না হয় । ফখরুদ্দিন ঘরে তালা দিয়ে বের হলো ।


সিড়ি দিয়ে নামার সময় পড়লো বিপদে। সিড়ির লাইটটা  কেউ অফ করে রেখেছে । লাইটের সুইচ টিপতে গিয়ে দেখলো আলো জ্বলছে না । ব্যাপার কি? আবার নষ্ট হয়েছে? মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখলো অবস্থা তারচেয়েও খারাপ । লাইটটা ই নেই । সকেটের দিকে তাকিয়ে ফখরুদ্দিন বললো, না থাকার বেদনা আমি বুঝি রে বুঝি । এমন সময় আবার কল এলো । তিনি নয় তো? নামটা যে কেনো জিজ্ঞেস করা হয়নি! কল ধরতেই অপর পাশ থেকে চিকন স্বর শোনা গেলো । ছেলেমানুষি গলায় জিজ্ঞেস করলো, 

  • ফখরুদ্দিন ভাই? আমি আরিফ । আমার মামা হয়তো আপনাকে কল করেছেন রক্তের জন্যে?

  • আপনার মামার নাম কি -

  • জহির । কল করেছেন?

  • জ্বি জ্বি করেছেন । আমি রাস্তাতেই আছি ।  

  • শুকরিয়া ভাই । এমন একটা সময়ে রক্ত পাওয়া যে কত কঠিন। আমি দূরে না থাকলে দেখা করতাম আপনার সাথে । 

  • অসুবিধা নেই ভাই । আমরা তো আছি 

  • আমি জানি আপনাদের মতো মানুষের জন্যেই বেঁচে থাকা সহজ হয় । ভালো থাকবেন ভাই । আসসালামু আলাইকুম


  

আমরা ভালো মানুষরা তো জীবন সহজ করে দিব কিন্তু আমাদের জীবন কে সহজ করবে? প্রশ্নটা অদৃশ্য কোনো অস্তিস্ত্বের উপর ছুড়ে দিয়ে ফখরুদ্দিন পকেট থেকে চাবি বের করলো গেইট এর তালা খোলার জন্যে। তালা খুলতে গিয়ে দেখলো তালার স্থানটা ফাঁকা। এই নিয়ে কত বার তালা চুরি হলো? মাসে একবার করে তালা চুরি হচ্ছে। কিছুদিন তালাবিহীন গেইট থাকে । কয়েকদিন পর দেখা যায় কেউ এসে চাবি দিয়ে ৩০টাকা করে নিচ্ছে। কেন চুরি হচ্ছে, কার দোষে, প্রতিকার কি- এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। নিরবে সয়ে যাচ্ছে । সময়ের হাওয়া বদলাচ্ছে, তালা বদলাচ্ছে, অবাঞ্ছিত চাবি জমা হচ্ছে ড্রয়ারে।


রাস্তায় দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক দেখলো। অটোরিকশা কিংবা মিশুক যদি পাওয়া যায় । রাস্তায় প্রাণী বলতে কুকুর, বিড়াল, আর শব্দ বলতে কীটপতঙ্গের ক্যাচ ক্যাচ শব্দ। গায়ে অক্টোবরের ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে । বেশ খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে একেকটা মোটরসাইকেল যাচ্ছে । যাত্রীহীন অটো কয়েকটা সামনে দিয়ে গেলো। হাক দিতেই চালক ফখরুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো । পাখি বাসায় ফিরছে, ভাবলো সে। এদিকে দেরি হচ্ছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মিনিটের কাটা ছয় এর ঘরে। বেশি দেরি হয়ে যাবে না তো? গিয়ে যদি দেখা যায় রোগী রক্তের অভাবে পরপারে চলে গেছে? 


এমন সময় একটা মিশুক পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো । ফখরুদ্দিন “মামা হাসপাতালে যেতে হবে, ইমার্জেন্সি” বলে হাক দিলো । মিশুক একটূ দূরে গিয়ে থামলো। মিশুকের মামা কিছুক্ষণ ভেবে গাড়িটা পেছনের দিকে আনলো । ফখরুদ্দিন যোগ করলো,

  • রোগীর অবস্থা ভালো না মামা। রক্ত না পেলে কি হয় না হয় 

মামার বয়স সমবয়সী ভাই এর সমান । জীবন পরিপক্বতার ছাপ এনে চেহারায় বসিয়েছে। বললো,

  • যাইতেছিলাম তো বাসায়। আচ্ছা আসেন। 

  • ভাড়া কিন্তু ৫০টাকা করে

  • আসেন। বাড়াইয়া দিয়েন, ভাই

ফখরুদ্দিন সিটে বসতে বসতে বললো, বাড়তি দিলে যে আমার আসার ভাড়া থাকে না, মামা। 

  • না দিলে চলা কষ্ট হয়

  • দিলে তো আমার পায়ের চলা কষ্ট হবে, মামা


মিশুকের গতি বাড়িয়ে চলতে লাগলো শহরের সাপের মতো ওলি-গলি দিয়ে। রাতের মোলায়েম বাতাসটা গায়ে ঝাপটা দিচ্ছে। চার দেয়ালের বদ্ধ হাওয়া থেকে বেড়িয়ে ফখরুদ্দিনের ভালো লাগছে । পা টা ছড়িয়ে বসতে পারলে হতো কিন্তু জায়গা নেই। সিটটাও হেলান দেয়ার মতো না। রাস্তায় মাইনের মতো খানা-খন্দ। মিশুক তীব্র গতিতে সেগুলোর উপর দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ভীষণ রকম ঝাঁকি দিচ্ছে। নাড়ী-ভুরি এক করে দিবে এমন অবস্থা । ফখরুদ্দিনকে বলতেই হলো,

  • আস্তে মামা, রোগীর জন্যে যাচ্ছি, রোগী হতে না!



 

মিশুক মেডিকেলের দ্বিতীয় গেইটের সামনে থামলো। মানিব্যাগ এর গহ্বর খুজে কত গুলো ৫টাকার কয়েন বাড়তি পেলো । সেগুলো সহ হাতে দিলো। রাস্তা প্রায় ফাঁকা । মাঝে মধ্যে ভারি ট্রাক, মোটর সাইকেল, আর অটোরিকশা যাচ্ছে । পরিবেশটা নিরব তবে ঠিক নিরবও না । কেউ একজন বলেছিলেন পৃথিবীতে এবসেল্যুট বলে কিছু নেই। কে বলেছে? কোনো বিজ্ঞানী নিশ্চয় । ফখরুদ্দিন জহির নামের ভদ্রলোককে  কল করলো । দেখা হলে কি  ডাকবে? মামা? আরিফ ছেলেটার গলা শুনে মনে হয়েছে বয়স প্রায় তার মতো হবে । সে যেহেতু ডাকে ফখরুদ্দিনের ডাকতে দোষ নেই। মামা ডাকা যায়।  রিং হচ্ছে । তৃতীয়বারে অপর পাশ থেকে আওয়াজ এলো,

  • এসে গেছেন?

  • জ্বি, আমি গেইটের কাছে

  • আচ্ছা আমি নেমে আসছি-

  • না না, নামতে হবে না। তিন তলাতেই তো আছেন?

  • জ্বি জ্বি

  • আচ্ছা আসছি


মেডিকেল দালানটা এল শেপের । এর দুটো ফটক । একটা দিয়ে টিকেট কাউন্টার সামনে পড়ে । অপর পাশটা বহির্বিভাগের রোগী দেখার জন্যে । ফখরুদ্দিন সদর গেইটটা দিয়ে ঢুকলো। ভেতরে আলো বলতে ৬০ওয়াট এর হলদে বাতি। অন্ধকার সেই বাতির আশে-পাশে গোল করে বসেছে। সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ফখরুদ্দিনের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে । ফাঁকা কাউন্টার পেরিয়ে লিফটের কাছে এসে দাঁড়ালো। উপরমুখী তিন কোণা সুইচে দুবার চাপ দিলো।  


  • লিফট বন্দো আছে, সিড়ি দিয়া উঠেন


ফখরুদ্দিন আঁতকে উঠলো । আশে পাশে তাকালো শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টায়। আসার সময় তো কাউকে দেখতে পেলো না। মানুষ, নাকি-

  • ভয় পাইছেন নাকি

  • না না ভ ভয় পাওয়ার কি আছে

কাউন্টার এর বাম পাশ থেকে একটা চিকন অবয়ব বেড়িয়ে এলো। হাতে লাঠি । দৈর্ঘে ৫ ফুট চার ইঞ্চি হবে ।  ফখরুদ্দিনের চাইতে দুই ইঞ্চি কম । মোবাইলের আলো জ্বালালো । সামনে আসতে দেখতে পেলো  বাদামি চেহারায় সাদা দাঁড়ির একজন মানুষ। গায়ে নাইট গার্ডের পোশাক। কিছুটা স্বস্থি নিয়ে ফখরুদ্দিন বললো, 

  • এমনে চিপা থাইক্কা হুট কইরা ডাকলে ভয় তো লাগবোই, চাচা!

চাচা হো হো করে আসলেন । ফখরুদ্দিন আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় মোবাইলের রিং বেজে উঠলো। সেই লেক্রিমোসা । জহির কিংবা আরিফ হয়তো । নাম্বার যদিও ভিন্ন কিছু বলছে। ফখরুদ্দিন সেই চিকন সুই এর ব্যথা অনুভব করলো। কলটা রিসিভ করে কানে দিলো, অপর পাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো,


  • নীল ভাই বলছেন?


যেটা শঙ্কা করেছিল তাই ই । এইসব কল রাতেই আসে ফখরুদ্দিনের কাছে । দিনে কল দিতে কেউ স্বাচ্ছন্দবোধ করে না । করার মতো না । ফখরুদ্দিন ইশারায় চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। মনে মনে অপর পাশের নারীর বয়স অনুমান করার চেষ্টা করলো । কত হবে? উনিশ? পঁচিশও হতে পারে । একবার তেরো বছরের মেয়েকে বিশ ভেবে বসে ছিল ।   


  • জ্বি আপু, বলছি । 

  • ও 

  • আপু কথা বলার আগে একটু বলুন তো রুমের পাশে বারান্দা আছে?

  • আছে

  • এক্টূ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো হয় । নেটওয়ার্কের একটু সমস্যা হচ্ছে । 

  • ও,আচ্ছা দেখছি 

অপর পাশ থেকে খস খস শব্দ হলো । খট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ এলো । 

  • জ্বি এসেছি। শুনতে পাচ্ছেন?

  • জ্বি জ্বি আপু এখন শুনতে পাচ্ছি । বেশ বাতাস দিচ্ছে

  • হু

  •  এমন সময়ে লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিলে ভালো লাগে । অন্তত আমার বেলাতে এই অষুধ খাটে । আপনি চাইলে প্রয়োগ করে দেখতে পারেন।

  • আমার মনে হয় না কোনো কিছুই আর কাজ করবে

ফখরুদ্দিন দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। পথিক হাল ছেড়ে দিয়েছে । বললো,

  • এখন যেভাবে নিশ্বাসটা ছেড়েছেন সেভাবেই একটা নিশ্বাস নিন । ভালো লাগবেই । দশটাকা বাজি ধরছি  

  • ইচ্ছে করছে না

বলার পরও ফখরুদ্দিন অপর পাশ এর নিশ্বাস নেয়ার শব্দ শুনতে পেলো । গুণলো। একবার । দুবার । তিনবার। জিজ্ঞেস করলো,

  • ভালো লাগছে?

  • জ্বি না। আপনি হেরে গেছেন । আপনার কাছে এখন দশ টাকা পাই 

  • ধ্যাত! কথা হলো। আচ্ছা আরেকবার চেষ্টা করে দেখি । এইবার বিশ টাকা বাজি

  • কি করতে হবে?

  • ঘরে চকলেট আছে?

  • থাকতে পারে। ছোটো রাক্ষস দুটো যদি খেয়ে না ফেলে আরকি 

  • আচ্ছা দেখুন আছে কিনা । 

  • আচ্ছা দেখছি। এইবারও হারবেন কিন্ত।

  • আচ্ছা দেখা যাবে


ফখরুদ্দিন তিন তলায় এসে গেছে। রেডিওলজি লিখা ব্যানার লাল আলোয় জ্বল জ্বল করছে। দেয়ালের এক পাশে জানালার কাছে স্টিল বডির চেয়ার পাতা । সেটার এক পাশে গিয়ে বসলো। মুখটা খোলা  জানালার দিকে ফিরিয়ে রাখলো । বাইরে সাদা সাদা দালান দেখা যাচ্ছে । প্রায় সবার ঘরের বাতি নেভানো। হাতে গোণা কিছু জানালার বাতি এখনো জ্বলছে । এমনই কোনো ঘর থেকে মেয়েটা কল করেছে হয়তো । পদক্ষেপটা  যে কত সাহসী ফখরুদ্দিন সেটা জানে। সবাই কল করতে চায় না । নিরবে চলে যেতে চায় ।

  • এই তো পেয়েছি! কিটক্যাট!

  • আমার প্রিয় একটা চকলেট। খেয়ে দেখুন। ভালো লাগবে

  • কচু লাগবে


অপর পাশ চকলেট চাবানোর মচমচ আওয়াজ আসছে। 

  • মিষ্টি খেলে ভেতরের তিক্ততা কিছুটা হলেও কমে। যায় না, তবে কমে। খিদে পেলে রাজ্যের যত ডিপ্রেসিং ব্যাপার আছে মাথার উপর এসে ভর করে। অন্তত আমার বেলায় তাই ই হয়। আপনার বেলায় খাটে কি না জানি না। 

  • হয় মাঝে মধ্যে।

  • এটা তো কাকতালীয় ভাবে মিলে গেলো! তবে এইযে তাল পড়ার মতো কল করলেন তার জন্যে কোন কাক দায়ী? 

  • আপনি সবার সাথে এভাবেই কথা বলেন?

  • কিভাবে কথা বলি?

  • কেমন কাব্যিক কাব্যিক ভাবে

  • জানতাম না তো আমার কথা এমন শোনায় । 

  • জ্বি, কি লাভ হয় এসব করে? 


ফখরুদ্দিন চুপ করে রইলো । ‘লাভ’ শব্দটা মাথায় নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখলো । আশে পাশে কোনো পেঁচা থাকে নিশ্চয়। হু হু করে রব করে উঠলো। 

  • একটা কাজ করা যাক। কাল দেখা করুন। শহরে কোথাও বসবো। আপনি আমার ব্যপারে জানলেন আমি আপনার ব্যাপারে জানলাম। অবশ্যই যদি আপুর এতে আপত্তি না থাকে ।  

  • এখন বললে ক্ষতি কি? নাকি দেখা করার নামে আপনার বদ মতলব আছে? আমার মামা কিন্তু র‍্যাব আগেই বলে রাখলাম। 

  • জেনে ভালো লাগলো নিরাপত্তা দেওয়ার মতো কেউ আছেন । এখন আসলে হাসপাতালে রক্ত দিতে এসেছি তো । এমনিই দেরী করে ফেলেছি । 

  • ওহ । আপনার আত্মীয়?

  • জ্বি না । অপরিচিত

  • অপরিচিত বললেই চলে যান, অপরিচিত কল করলেই ধরে ফেলেন। আপনি তো মিয়াঁ অদ্ভুত ।

  • হাহা। 

  • আচ্ছা ঠিকাছে কাল বিকালে না হয় আপনাকে কল করবো

  • জ্বি আচ্ছা আপু । অপেক্ষায় থাকবো । ভালো থাকবেন । 


ফখরুদ্দিন লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললো । যাক । বিপদ কেটেছে । আজকের রাতটা কেউ একজন ঘুমিয়ে কাটাবে অন্য কিছু না করে । 


ফখরুদ্দিন দাঁড়ালো । রিসেন্ট থেকে জহির সাহেবের নাম্বারটা খুজে বের করে কল করলো । ভদ্রলোক দ্বিতীয় রিং এ কল ধরে বললেন,

  • ভাই এসেছেন?

  • জ্বি এসেছি । ব্লাড ডোনেট করার রুমটার সামনেই দাঁড়িয়ে-

  • আচ্ছা আচ্ছা আসছি । দুই মিনিট লাগবে

  • জ্বি আচ্ছা 


যে ঘরটা থেকে সেম্পলিং নেয়া হয় সেটার দরজা বন্ধ। যিনি কাজ করেন তিনি রুমের আলো জ্বালিয়ে শুয়ে আছেন বিছানায় । ফখরুদ্দিন জানালার কাছে দাঁড়াতেই লোকটা মাথা ঘুড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ব্লাড দিতে আসছেন?” ফখরুদ্দিন বললো, জ্বি । লোকটা বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বললো, রোগী পক্ষের? ফখরুদ্দিন বললো, “জ্বি না, তবে উনি আসছেন । কি নাম আপনার?” রফিক, লোকটা বললো। 

রফিক নামের লোকটা মধ্যবয়সী । ফর্সা মুখে সাদা-কালো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি । গায়ে ফতুয়া আর লুঙ্গি । টেবিল থেকে চাবি নিয়ে রুমের দরজা খুট করে খুলে বের হলেন । ফখরুদ্দিনকে পাশের ঘরটা খুলে দিয়ে বসতে বলে তিনি ওয়াশরুমের দিকে চললেন । 


ফখরুদ্দিন মোবাইল বের করে ভাবছে ইবুক পড়া শুরু করবে কিনা এমন সময় দরজার কাছে এসে সাত কিংবা আট বছর বয়সী মেয়ে এসে দাঁড়ালো। চোখে-মুখে বুঝদার বুঝদার ভাব । ফখরুদ্দিন নাম জিজ্ঞেস করতে যাবে তখন মেয়েটার পেছনে এসে একজন লোক এসে দাঁড়ালো । ফখরুদ্দিন দাঁড়িয়ে গেলো, জিজ্ঞেস করলো,

  • জহির ভাই?

  • জ্বি, আসতে অসুবিধা হয় নি তো? এমনিতেই এত রাতে আসাটা একটা ঝামেলা-

  • না না অসুবিধা হয় নি। এই পিচ্চি কি-

  • হ্যা, আমার মেয়ে। ওর আম্মুর জন্যেই রক্তটা লাগবে । ও একটুও ঘুমাবে না । এই, নাম বলো ভাইয়া কে

পিচ্চি অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বললো, 

  • রুবাইয়াৎ রিধি

  • সুন্দর নাম তো! 

ফখরুদ্দিন চেহারার বিশ্ময়টা নিখাদ । জহির ভাই এর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,

  • কে রাখলো? ভাবি?

  • জ্বি । আমার রাখা নাম সে পরোয়া ই করলো না । বললো, কষ্ট করেছি আমি, নাম দেয়ার হকও আমার।

  • হক কথা 

জহির ভাই হাসলেন । বললেন, এই জন্যেই প্রতিবাদ করি নি। 

রফিক নামের লোকটা জহিরের পেছনে এসে দাঁড়ালো । দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললো, আসুন আপনারা। 


রক্তের সেম্পলিং নেয়ার সময় ফখরুদ্দিন খেয়াল করলো রিধি নামের মেয়েটা রক্ত ভয় পায় না । ছোট্ট একটা সুচ দিয়ে আঙ্গুল ফুটো করে এক বিন্দু রক্ত নিলো, তা দেখেই ফখরুদ্দিনের গা গুলিয়ে উঠলো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে কিনা দেখার জন্যে মাথা ঘুরাতেই চোখে চোখ পড়লো । অনেক আগ্রহ নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “ভয় পাচ্ছেন, ভাইয়া?” ফখরুদ্দিন প্রথমে ভাবলো মিথ্যা কথা বলবে । পরে কি ভেবে বললো, একটু পাচ্ছি, তোমার ভয় লাগে না? প্রশ্ন শুনে রিধির ভ্রু হালকা বাঁকা হলো। ঠোঁট হালকা তির্যক করে বললো, এহ! ভয়ের কি আছে, লাল পানি ই তো! ফখরুদ্দিন উত্তর শুনে জহিরের দিকে তাকালো । জহির হেসে বললো, মায়ের দিক এটা । এদের ভয়-টয় বলে কিছু নেই। 


রক্তের সেম্পলিং, মেচিং, আর ফি এর টাকা হাতবদল হওয়ার পর আবার তারা পাশের ঘরটায় এলো। রফিকের হাতে ব্লাড ব্যাগ। ফখরুদ্দিন বেড এ শুয়ে পড়লো। জহির আর রিধি তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে । বাপ মেয়ের চোখে মুখে শঙ্কা শঙ্কা ভাব । ফখরুদ্দিন তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।


  • হাতটা সোজা করে মুঠ করুন, রফিক প্রায় আদেশের সুরে বললো । 


ফখরুদ্দিন সোজা করে দিলো হাতটা। রফিক হাত দিয়ে টিপে টিপে রগ খুজে মোটা সুইটার মাথাটা ঢুকিয়ে দিলো। ফখরুদ্দিন কাঠপিঁপড়া কামড় খেলো যেনো। ঘন লাল তরল রক্ত সাদা ব্যাগে জমা হতে থাকলো । বাপ মেয়ে বেঞ্চে বসে রইলো এ প্রায় পুরোটা সময় । জহির হাতে মোবাইল নিয়ে কিছু একটা দেখছিলো । আর রিধি তাকিয়ে ছিলো ব্লাড এর ব্যাগটার দিকে । প্রায় আধ ব্যাগ হওয়ার পর জহির উঠে বললো, আমি আসছি, বসুন। রিধির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো সাথে যাবে নাকি বসবে। রিধি মাথা নেড়ে বললো, থাকবো। নিরবতার অস্বস্তি কাটাতে ফখরুদ্দিন মোবাইল বের করে ইবুক পড়তে শুরু করলো । পনেরো পৃষ্টা পড়া শেষ না হতেই দেখলো রক্ত নেয়া শেষ। রফিক রক্তের ব্যাগ নিয়ে পাশের ঘরে গেলো । রুমে এখন ফখরুদ্দিন আর রিধি । সময় কাটাতে হবে জহির ভাই আসার আগ পর্যন্ত । রিধি উঠে রফিকের বসা চেয়ারে বসতে বসতে বললো, 

  • কেমন লাগছে ভাইয়া? আব্বু বললো রক্ত দেয়ার পর অনেক দুর্বল দুর্বল লাগে।

  • ঠিক বলেছেন । তবে অভ্যেস আছে তো। সহ্য হয়ে গেছে । কি সে পড় তুমি?

  • ফোরে । আওয়ার লেডি অব ফাতিমা তে 

  • বাহ। স্যার-ম্যাম কেমন?

  • অনেক ভালো । সুন্দর করে পড়ায়। তবে বেশী প্রশ্ন করলে একটু রাগ করে

  • কে বেশী প্রশ্ন করে ক্লাসে?

  • আমিই 

  • হাহা । ভালো প্রশ্ন করা ভালো, অনেক কিছু জানা যায় । 

  • ভাইয়া কি অনেক কিছু জেনেছেন?

  • কখনো প্রশ্নই করি নি

  •  কেনো করেন নি? লজ্জা পেতেন? আমার ক্লাসমেট ফারিয়াও লজ্জার কারণে প্রশ্ন করে না।

  • লজ্জা হতে পারে । তবে আমার আগ্রহ আসে নি । তুমি নিশ্চয় একটা বিষয়ে বেশী জানতে প্রশ্ন করো?

  • হ্যা, মানে জ্বি । আপনি বেশী কিছু জানতে চান না?

  • নাহ। কি দরকার । দিনকাল এমনি পার করে দিচ্ছি । অপেক্ষা করছি শেষের…

  • শেষ মানে? 

ফখরুদ্দিন এর খেয়াল হলো সামনে কে বসে আছে । প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো, 

  • শেষ মানে বড় হয়ে কিছু হতে চাওয়া । কি হতে চাও? 

  • ফিজিসিস্ট । আমি পড়ার জন্যে বাইরে যাবো । খাবো, ঘুরবো, আর ছবি তুলবো । ইজমা আপুর মতো। 

  • ইজমা আপুটা কে? 

  • আমার চাচাতো বোন । বার্লিনে থাকে । আপুও পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ে । আমার জন্যে সুন্দর সুন্দর বই পাঠায় 

  • ভালো একটা আপু তোমার 

  • আম্মুর বেবিটা হলে আমিও আপু হবো! 

  • বোন কিন্তু অনেক জ্বালাবে বড় হলে 

  • মেরে মেরে সোজা করবো তখন 

  • তোমার আম্মুর অষুধ?

রিধি চোখ বন্ধ করে মাথা এক পাশে কাত করে মুখ টিপে হাসলো । মুখে বললো, 

  •  হু । আপনি কি হতে চান ? নাকি হয়ে গেছেন?  

  • ভাইয়ার ইচ্ছা মানুষ হওয়া। যেটা এখনো হতে পারি নি।

রিধি চোখ নিচু করে কিছু ভেবে আবার ফখরুদ্দিন এর দিকে চোখে চোখ রেখে বললো, 

  • ঐ মানব কল্যাণের জন্যে  কিছু করার মতো মানুষ হওয়া? এইতো? 

  • এইটাই । একদম ।

  • আমার মামাও সেসব করে । গরীবদের খাবার বানিয়ে দেয় । ফ্রি স্কুল দিয়ে তাদের ধরে ধরে এনে পড়ায় । আমিও মাঝে মধ্যে সাথে সাথে যাই । সেটা জিজ্ঞেস করি নি । বলেছি আপনি নিজের জন্যে কি করেন?


ফখরুদ্দিন অবাক হয়ে তাঁর সামনে বসা এই পুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে । কত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে । ইতোমধ্যে ভেবেও রেখেছে কোথায় যাবে, কি হবে । যে প্রশ্ন ফখরুদ্দিন নিরবে মনের কোণায় নিয়ে নাড়া-চাড়া করে সেই প্রশ্ন ছোট্ট মেয়ের মুখ দিয়ে যে সরব হয়ে বের হবে সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না । কি করেছে সে নিজের জন্যে?


  •  ভাইয়া আসলে সময় ই পাই না ভাবার । অনেক ব্যাস্ততা যে। ভার্সিটি যেতে হয়, সার্ভাইবার্স অর্গানাইজেশনে আছে, টিউশন থাকে । এসব করে আসলে ভাবার শক্তি থাকে না। 

কৈফিয়তের সুরে বলা কথা গুলো সামনে বসা ছোট্ট মেয়েকে বললো নাকি নিজেকে বললো ফখরুদ্দিন নিশ্চিত না । 

  • মানে সখটখ কিছুই নেই ভাইয়ার? 

  • ছিল এক সময় । আঁকাআঁকি করতাম । এখন কেনো যেনো করি না । তোমার আছে? 

  • অনেক । বই কিনি, বই পড়ি, ছবি তুলি, ক্রাফট বানাই । বন্ধুর সাথে হাটতে যাই

  • বন্ধু? বন্ধুরা না? তোমার বয়সীদের তো অনেক ফ্রেন্ড হওয়ার কথা 

  • ক্লাসমেট অনেক আছে । কিন্তু বন্ধু একজন থাকতে হয় । আপু বলেছে

  • তোমার আপু মনে হচ্ছে তোমার স্পিরিচুয়াল গাইড।

  • স্পিরিচুয়াল কি? 

  • স্পিরিচুয়াল হচ্ছে বিশেষণ । এসেছে স্পিরিট থেকে । যা হলো বিশেষ্য । মানে হচ্ছে আত্মা । তোমার আপু তোমার বাইরেটা কিভাবে ঠিক রাখতে হয় সেটা বলে দিচ্ছে তাই তিনি স্পিরিচুয়াল গাইড। 

  • বুঝি নাই


ফখরুদ্দিন এতক্ষন আধশোয়া হয়ে কথা বলছিলো । সোজা হয়ে বসে বললো,

  • একটা কাঁচের বাটি কল্পনা করো। সেটা সাদা স্বচ্চ পানিতে ভর্তি । তোমার শরীরের বাইরেটা কাঁচের বাটি । আর আত্মাটা টলটলা পানি । তোমার আপু তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে হাঁটতে হয় যাতে বাটীর পানি নিচে না পড়ে । এইবার বুঝলে?

  • মনে হচ্ছে । আপনার বাটিতে পানি আছে?

  • অনেক আগেই পড়ে গেছে

  • কেনো? কেউ কিভাবে হাঁটতে হয় সেটা বলে দেয়নি বলে?

  • হয়তো



                                                                 (চলবে(?)





-বিষাদ

১৭/০৯/২৪ Nowhere Man by Beatles



Comments

Popular posts from this blog

অনর্থক

Why Not to Fall in Love with your Dream Girl