২৪/১০/২৪

 


Sharif and Ahmad




আহমেদ এর বয়স সাত কিংবা আট হবে । গায়ের রঙ ময়লা । গায়ে হাফ হাতা নীল গেঞ্জি আর রঙ উঠে যাওয়া জিন্সের প্যান্ট । গোড়ালি পর্যন্ত প্যান্টের নিচের কোণা ছেড়া । স্বভাবে-কথায় চপলতা । শরিফ কে জিজ্ঞেস করছিল ঢাকায় কিভাবে যেতে হয় ।  কোন গাড়ী আছে কিনা । শরিফও সাদামাটা ভাবে বলে দিচ্ছে কিভাবে  কোন পথ দিয়ে যাবে । ছেলেটা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো, নিরবে মনে মনে টুকে নিচ্ছিলো প্রত্যেকটা শব্দ । বারবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছিলো ঠিক শুনেছে কিনা । আমি পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনে যাচ্ছি আর ভাবছি এইটূকু ছেলে সাহস করে ঘর থেকে পালাতে পারে আর আমি এখনো আমার অবসেশন থেকে পালাতে পারছি না?

*

রাতেই খবরে বলে দিয়েছিলো সকালের দিকে ঘুর্ণিঝড় 'ডানা' বাংলাদেশের সুন্দরবন আর ভারতের পূর্বাঞ্চলের দিকে আঘাত হানবে । আকাশ তারই প্রভাবে মেঘলা । 

সকাল ৯ঃ১০ এ যখন বের হলাম তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে খেয়াল হলো, মনে এলো ছাতা নিতে ভুলে গেছি। পেছনে ফেরার প্রশ্নই আসে না ।  ৩য় সেমিস্পটার পরিক্ষার দিন । এডভেন্সড রাইটিং ২১১ । কতটুক লিখতে পারবো সে বিষয়ে পরম সংশয় । কান্দিরপাড় থেকে শরিফসহ অটো তে উঠতে উঠতে ১৫ বেজে গেলো। আর সিএনজিতে উঠার পর ৩০ । 

সিএনজি তে আমার পাশে বসে ছিল এক পিচ্চি মেয়ে আর মা । মা ভীষণ রেগে আছে । মেয়ে অনুশুচনায় । মা মেয়ে কে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি আসলেই অংকে ভুল দিয়ে আসছিস নাকি ফাইজলামি করতেসিস? অংকে ভুল দিয়ে আসা মেয়ে বেশ উৎসাহের  সাথে বললো, সত্যিই ভুল দিয়ে আসছি! মা শুনে চাপা রাগ নিয়ে বললো, আশের পাশের ছেলে মেয়ে গুলা যখন একশোতে একশো দশ পাবে তখন তুমি পাবা শুণ্য ।দেখবা তখন কেমন লাগে । মেয়ে হাতে থাকা ফোল্ডার এ মাথা ফেলে দিলো। কেনো যেনো মা-মেয়ের কথা শুনে আমার হাসি আসছিল । 

*

কুবির গেইটের কাছে নামার পর দেখলাম ঘড়ির মিনিটের কাঁটা ৯ এ । শরিফ এর হেলে দুলে আসতে দেখে রাগ লাগছিল । বার বার বলতে হলো তাড়াতাড়ি হাঁটতে । গিয়ে দেখি খাতা দিয়ে ফেলেছে । আমাদের পেছনে পেছনে ই ম্যাম ঢুকলেন । পরবর্তি তিন ঘন্টা আজাব এর মতো কাটলো । আমি যখন লিখতে হিমশিম খাচ্ছি তখন দেখলাম অনেকে এক্সট্রা শিট নিচ্ছে । আজমি'র মা নিলো, বোরকা পড়া একজন নিলো (পরিচয় হয়নি কখনো) সহ আরও অনেকে । মিস টি সহ অবশ্যই । সামনে আসতেই চেহারায় চোখ পড়লো । দেখার পর খেয়াল হলো মস্ত বড় ভুল হয়েছে । তাকানো উচিত হয় নি । এটোমিক বোমার মত জীবন্ত একটা ট্রিগার । সোশাল মিডিয়াকে চিরতরে ইস্তফা দিয়েছি এ কারণে । যাইহোক এক্সাম দেয়ার পর খেয়াল হলো একটা প্রশ্ন ঠিকমতো না পড়ার কারণে এন্সার করা হয় নি। ২ নাম্বারের প্রশ্ন । আরেকটা ট্রমা ।  

*

সেদিন টার্ম পেপার জমা নেয়ারও দিন ছিলো । আমি আগের রাতে করে ফেলেছি, শরিফ বিবলিওগ্রাফি হজবরল করে রেখেছে । দোকানের সামনে তাই অনেকক্ষণ দাড়াতে হলো । কুবি গেইটের আইল্যান্ডে তখন চোখ পড়লো । সে বসে আছে । হাতে মোবাইল । অপেক্ষা করছে কারোর জন্যে? আমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হলো । নাহ, এমনিই অবসেশন বাজে অবস্থায় আছে । এটা বাড়ানোর প্রশ্ন আসেনা । সে মেয়ে হওয়ার আগে একজন মানুষ । মানুষ হিসেবে তাঁর চাহিদা থাকতেই পারে । আমি আমার জন্যে সেরাটা খুঁজে নিতে পারলে তাঁর বেলায় কেনো নিয়ম ভিন্ন হবে?  আমি 'সেরা' নই এটা আমার জনম জনমের দুঃখ থাকবে । 

*

ডিপার্টমেন্ট এ গিয়ে জমা দিয়ে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেলো । বাসের সিট ইতোমধ্যে দখল হয়ে গিয়েছে । তাই দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছিল । বাসের দিকে হাটার সময় দেখলাম বাসের পেছনে ইব্রাহিম, ফারুক, আর ফাহিম কথা বলছিলো কিছু একটা নিয়ে । আমি আর শরিফ গিয়ে দাড়ালাম পাশে। একটু পর সে আর সে এসে পেছনে দাঁড়ালো । নিজেদের মধ্যে কথা বলছে । আমার খেয়াল হলো আমার মাথায় আবার এন্টেনা গজাচ্ছে । আমি মুখটা অন্যদিকে ঘুড়িয়ে নিলাম । প্রাণপণে চেষ্টা করলাম সেদিকে না তাকাতে । আমার ভেতরের মানুষটা মরে গিয়ে বাহিরে কীটের স্বরুপ এখন দিনের আলোর মতো প্রকাশ্যে । বাস ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছে । আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে গেলাম । শরিফ, ইব্রাহিম, ফারুক তিন সারি সামনে বসে আছে। এরপর সে "তাঁকে" বিদায় জানিয়ে বাসে এলো । আমি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বাসের জানালা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম । বার বার ধিক্কার দিচ্ছি কেনো আমার স্বপ্নেই তাঁকে আসতে হলো? 

*
বাস ছেড়ে শহরমুখী হয়েছে । আর আমি অন্তরমুখী । স্বপ্ন নিয়ে ভাবছি । 

না, সিনামার মতো মনের মানুষ কে স্বপ্নে পাওয়ার কথা বলছি না । হয়তো অন্য সবাই নিজের মনের মানুষ কে সুন্দর দেখতে চেহারায় পায় । আবার বেলায় হলো উল্টোটা । শুরুটাই হলো মেডিয়াস রেসে । একটা ঘরের মাঝে আমি দাঁড়িয়ে । ঘর প্রায় অন্ধকার। আধো আলোয় দেখছি সামনে একটা মেয়ে শুয়ে আছে । তাঁর চেহারা প্রায় স্পষ্ট । প্রায়। চেহারায় জেল্লা নেই । ঘামে চুবে গেছে । যমদূত এখনি নিয়ে যাবে অবস্থা । আমি হতভম্ব । কি হচ্ছে । কেনো হচ্ছে কিছুই মাথায় আসছে না । আপনা থেকে মনে হলো এখনি হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে । দৌড়ে বাহির হয়ে রাস্তায় এলাম । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে । মনে হলো গভীর রাত । রাস্তা ফাঁকা । কোনো শব্দ নেই । বৃষ্টি পড়ার শব্দও না । কোনো কারণ ছাড়াই মনে হলো সে মারা গেছে । গাড়ি খোঁজার মানে হয় না । কান্না আসা দরকার কিন্তু তাও আসছিলো না । কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো ভেতরটা । কোনো রকম আগাম সতর্কতা ছাড়াই একটা ট্রাক আসে আমার গায়ে এসে পড়লো । আমার স্বপ্ন ভেঙে গেলো । এই নিয়ে কয়বার দেখেছি এই স্বপ্ন? গুনতে ভুলে গেছি । ভর্তির এক সপ্তাহ আগে যে শুরু হয়েছিলো তাঁর যেনো শেষ হওয়ার নাম নেই । এক সপ্তাহ কে মনে হচ্ছিলো এক বছর । ইতি টানলো কখন? যখন ক্লাসে এসে তাঁর দিকে চোখ পড়লো । তার চেহারা দেখে যে অবাক হয়েছি তাঁর রেশ কাটতে অনেক সময় লেগেছিলো । অনেক সময় । 

*

বাসের ঝাকুনি খেতে খেতে যাচ্ছি । বিশ্বরোড পর্যন্ত এসেছি । মেঘের ঘন কালো একটা পর্দা পশ্চিম দিক থেকে পুর্ব দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসছে । দানবের মতো শহরটা গোগ্রাসে গিলে ফেলতে আসছে । তিন সারি এগিয়ে ইব্রাহিমরা বসে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিলো । আমাকে ডাকছিলো । আমি গেলাম না । কালো মেঘের মতো কিছু একটা আমাকেও গিলে খাচ্ছে । কি সেটা? 

বাহিরে বাতাসের দমকা হাওয়ায় রোডের পাশে দোকানের টিনশেডের উপরের পাতা গুলো উড়ে আকাশে বন বন করে ঘুরতে লাগলো । ঝিড়ি ঝিড়ি বৃষ্টি দিক ভুলে এদিক সেদিক যাচ্ছে । খেয়াল হলো আমার একাকি মন স্বপ্নের ব্যাপারটার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে । স্বপ্নের সাথে মনের মানুষ আসার ভবিষ্যৎ বাণীর সম্পর্ক নেই । এ শুধুই একটা ভুল । রঙ নাম্বার এর রঙ স্বপ্ন । ভুল করে আমার কাছে চলে এসেছে। আমার মতো কীটের কাছে তাঁর মতো মানুষের খবর আসবে কেনো??

খোদা ভুল করেছে 


জায়গায় বাস থামতেই শরিফ বললো নামবে । আমি অবাক হলাম এখানে নামবে কেনো । টিউশনি করায় নাকি এখানে? ইশারা করে আমাকেও নামতে বললো । কালো চিন্তায় মন বিষিয়ে আসছিলো বাসে।বাসে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না  । নেমে গেলাম । বৃষ্টির ঠান্ডা ফোঁটা গায়ে পড়তেই ভালো লাগতে লাগলো । লম্বা একটা নিশ্বাস নিলাম । এইতো চাইছিলাম । সতেজ হাওয়া । জিজ্ঞেস করলাম, ঘুরবি নাকি? শরিফ বললো ভিক্টোরিয়াতে কাজ আছে । কোন ফ্রেন্ডের এম এ সার্টিফিকেট তুলতে হবে । তারপর নাহয় স্টেশন যাওয়া যায় । কলেজ গেইটের কাছে এসে দেখলাম কয়েকজন হন্তদন্ত হয়ে হয়ে বের হয়ে আসছে । নিচে চোখ পড়তে দেখলাম একজনের জুতায় রক্ত । জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে হলো। বললো, টেবিল পরেছে । আমার নিজের স্মৃতি মনে হয়ে গেলো । একই ব্যাপার । বুড়ো আংগুলের পড়ে ছিলো । নখটা লুজ হয়ে গিয়েছিল । ফারুক মামার চেম্বারে গিয়ে নখ তোলার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিলো । যাইহোক, দেখা গেলো যে কাজের জন্যে কলেজে আসা সে কাজ আর হয় নি । অফিস থেকে বললো, এখন হবে না । তিনটার পর । যিনি সার্টিফিকেট দিবেন, উনিই নাই । আর পরিক্ষার সময় তো অফিসে ঢুকা নিষেধ । 

অফিস থেকে বের হতে গিয়ে বৃষ্টি মনের সব আনন্দ ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে । সেই আনন্দের ভেজা ঠেকাতে শরিফ এর ছাতা খুলতে হলো । লাভ হয়েছে? না্‌হ, আমার ডান কাধ ভিজে চুপসে গেছে । ভেতরে ইভান পুশেকের বই আছে । সেটা ভিজে গেলে সর্বনাশ হবে । ভেজা ঠেকানো অবশ্য যায় নি । রেলগেটে পর্যন্ত যেতে যেতে পুরো গিজে গেছি । বৃষ্টির সাদা চিকন একটা চাদর আমার চোখের সামনে । শরিফ এর মোবাইল দিয়ে একটা ভিডিও করলাম (আমারটা দিয়ে ভালো আসে না) । ইশটিশন এর প্লাটফর্মে পা দেয়ার পর আমার চা খেতে ইচ্ছে করলো । 

*

চা কোথায় খাওয়া যায় সেটা ভাবতে ভাবতে আমরা হাঁটতে লাগলাম । 

Comments

Popular posts from this blog

Gale Dreams About Flying Whale

Why Not to Fall in Love with your Dream Girl

Meet