বই এর অনুবাদ
প্রথম অধ্যায়ঃ অনুপমদের উত্থান
যেভাবে চপলতা সাংস্কৃতিক আদর্শ হলো
ক্যানসাস শহর থেকে একশো মাইল দূরে ছোট্ট একটা গ্রাম আছে । ম্যাপে খুঁজতে গেলে সরু চোখে তাকিয়ে খুঁজতে হয় । জায়গাটার নাম হারমনি চার্চ, মিজৌরি । যাকে নিয়ে আমাদের এই গল্পটা সে হাই স্কুলে পড়া একজন কিশোর । তার নাম ডেইল । স্বভাব ভালো তবে একটু অনিরাপত্তায় ভোগে ।
খেলাধুলায় আগ্রহ তেমন নেই । তাই শরীরটাও খুব একটা অগ্রগতি হয় নি । মেজাজটা খিটখিটে । ডেইলের বাবার একটা শুকরের খামার আছে । তবে সেই কবে যে একবার দেউলিয়া নামের চোরাবালিতে পরেছেন তারপর থেকে আর উদ্ধার হতে পারেন নি । অর্থের অভাবে কিন্তু তার মাথায় কোনোদিন চোরাপথ নেয়ার চিন্তা আসেনি । নীতিবাগিশ বলা চলে । ডেইল বাবার কথা মাথা পেতে নেয় । তবে যেটা সে নিতে পারে না সেটা পরিবারের দারিদ্র । ভয় হয় এই দারিদ্রের মাঝেও তাঁকে চলতে হয় কিনা । তার ভয়ের শেষ নেই । বৃষ্টি বাদলার দিনে মাথায় বাজ পড়ার ভয় । জেনে না জেনে করা পাপের পরিণতির ভয়, কিংবা কথা বলতে গেলে মুখ জড়িয়ে যাওয়ার ভয় । এই ভয় যে শুধু তার বর্তমানকে গ্রাস করে আছে এমনও না । বিয়ের পর নতুন বউ এর সাথে কথা বলতে পারবে কিনা সেটাও সে ভেবে বসে আছে!
একবার শাটোকোয়া থেকে একজন এলেন বক্তব্য দিতে । শাটোকোয়া জিনিসটা কি একবার বলে নেই । শাটোকোয়া হচ্ছে ১৮৭৩ সালে জন্ম একটা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন যার আস্তানা হচ্ছে নিউ ইয়র্কের পূর্বাঞ্চলে । সেই সংস্থা থেকে নানান স্বনামধন্য বক্তা সারাদেশে ঘুরে ঘুরে সাহিত্য, ধর্ম, আর বিজ্ঞান নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন । গ্রামে গঞ্জের মানুষরা এই বক্তাদের খুবই সম্মানের চোখে দেখেন । তাদের শহুরে শব্দচয়ন শুনে তারা মুগ্ধ না হয়ে পারে না ।
এমনি একজন বক্তার কথা শুনে ডেইল এর ভালো লেগে গেল । তিনি তার জীবনে কি করে গরীব থেকে ধনী হলেন তার গল্প বললেন । ছিলেন চাষির ছেলে । ভবিষ্যৎ মাঠে জন্মানো সোনালি ফসল এর মত হবে এই আশা তার ছিল না । কিন্তু তবু হিম্মত করে কথা বলার কৌশল রপ্ত করলেন আর উঠে গেলেন শাটোকোয়ার মঞ্চে । আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি । ডেইল মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে তার প্রত্যেকটা কথা ।
সে ঘটনার কয়েক বছর পর ডেইল আবার মুগ্ধ হলো পাবলিক স্পিকিং এর ভেল্যু দেখে । তার কলেজের হোস্টেল খরচ বাঁচাতে তার বাবা খামারটা কলেজের কাজে শিফট করলেন । ডেইল খেয়াল করলো যে যেসব ছেলেরা ক্যাম্পাসের নানান বক্তব্য প্রতিযোগিতায় জয়ী হয় তাদেরকে সবাই খুব সমীহ করে চলে, তাদের কথা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে । ডেইল সিদ্বান্ত নিলো সেও এই কৌশল রপ্ত করবে । সে প্রত্যেক প্রতিযোগিতায় নাম লেখালো আর রাতে বাসার দিকে ছুটতো প্র্যাক্টিস করার জন্যে । হেরেছে বহুবার । কিন্তু সে মানুষটা জেদি । জেদ এর ফলও পেলো। একটা পর্যায়ে কলেজে নিজেকে সেরা বক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলো আর ক্যাম্পাসের শিরোমণি হয়ে উঠলো ।
১৯০৮ সালে ডেইল যখন কলেজ এর গন্ডি পার হলো তার পরিবার এর অবস্থা তখনও ততটা পালটায় নি । তবে দুনিয়া অনেকটা পাল্টে গেছে । করপোরেট এর রাজত্ব চলছে । হেনরি ফোর্ড মডেল টি গাড়ি দমাদম বিক্রি করছেন । জে সি পেনি, উলওর্থ আর সিয়ার্স রুবাক এর নাম সবার মুখে মুখে । ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চলে এসেছে । টয়লেটের জন্যে আর বাইরে দৌড় লাগাতে হয় না । ঘরের ভেতরই সুন্দর ব্যবস্থা এখন ।
পরিবর্তিত সময়ে মানুষও চাই তেমন । একজন স্যালসম্যান, যার হাসি সদা প্রস্তুত থাকে, মোলাকাতের সময় হাতটা বাড়িয়ে দেয়, কলিগের সাথে হেসে হেসে পাল্লা দিতে পারে যে । ডেইল এমনি একটা ভীড়ে নিজেকে ভিড়িয়ে নিলো। সাথে সম্বল মাত্র তার কথা বলার জাদু ।
ডেইল এর শেষ নামটা কারনেগি । শুরুর কয়েকটা বছর বেশ কষ্ট করতে হয়েছে । আর্মর এন্ড কোম্পানির হয়ে গরুর গোশত বিক্রি করেছেন । তারপর পাবলিক স্পিকিং এর উপর একটা কোর্স শুরু করলেন । তার জীবনের প্রথম ক্লাস নিলেন নিউ ইয়র্ক শহরের ১২৫ নম্বর স্ট্রিটের YMCA নামের একটা সংস্থায় । রাতের বেলায় কোর্স নেয়া হবে । বেতন হিসেবে ডেইল প্রতি সেশনে দু ডলার করে চাইলেন পরিচালকের কাছে । পরিচালক ধরে নিয়েছিলেন রাতে কেইবা আসবে পড়তে তাই আর রাজি হননি এই বেতনে।
তবে একটা মজার ব্যাপার হলো । রাতারাতি খবরটা ছড়িয়ে গেল চারপাশে । এই সফলতার রেশ ধরেই ডেইল নিজের নামে একটা প্রতিষ্ঠান খুলে ফেললো । নাম দিলো ডেইল কারনেগি ইনস্টিটিউট । একসময় যে অনিরাপত্তায় তিনি ভুগেছেন সেই অনিরাপত্তার ভূতগুলো এখন তিনি ব্যবসায়ীদের ঘাড় থেকে তাড়ান। ১৯১৩ সালে তিনি তার প্রথম বই প্রকাশ করেন । ব্যবসায়ীদের মাঝে বেশ আলোড়ন তুলে সেই বই। তারই এক অংশে তিনি লিখেছেন, “একটা সময় ছিল যখন মানুষ পাবলিক স্পিকিং দক্ষতা ব্যাপারটাকে খুব বাঁকা চোখে দেখতো আর আজকাল এই দক্ষতা ছাড়া এক কদমও আগানো যায় না।”
Translated from the book 'Quiet' Written by Susan Cain
Comments